পটভূমি
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয় - পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী চিরকালের মত স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানী সামরিক শাসকেরা পঁচিশে মার্চ রাতে নিরীহ পূর্ব পাকিস্তানীদের ওপর লেলিয়ে দেয় হিংস্র পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী, দেশজুড়ে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট নামক বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞ।[৮] পাকিস্তানী সেনাদের এই ভয়াবহ আক্রমনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ।
পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশার ইতিহাস
অর্থনৈতিক বৈষম্য
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।[৯]বছর | পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্কলিন ব্যয় (রুপী কোটিতে) | পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্কলিন ব্যয় (রুপী কোটিতে) | পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়ের শতকরা পরিমাণ |
---|---|---|---|
১৯৫০-৫৫ | ১,১২৯ | ৫২৪ | ৪৬.৪ |
১৯৫৫-৬০ | ১,৬৫৫ | ৫২৪ | ৩১.৭ |
১৯৬০-৬৫ | ৩,৩৫৫ | ১,৪০৪ | ৪১.৮ |
১৯৬৫-৭০ | ৫,১৯৫ | ২,১৪১ | ৪১.২ |
মোট | ১১,৩৩৪ | ৪,৫৯৩ | ৪০.৫ |
বৈষম্য বিষয় | বাংলাদেশ | পশ্চিম পাকিস্তান |
---|---|---|
রাজস্ব খাতে ব্যয় | ১৫০০ কোটি টাকা | ৫০০০ কোটি টাকা |
উন্নয়ন খাতে ব্যয় | ৩০০০ কোটি টাকা | ৬০০০ কোটি টাকা |
বৈদেশিক সাহায্য | শতকরা ২০ ভাগ | শতকরা ৮০ ভাগ |
বৈদেশিক দ্রব্য আমদানী | শতকরা ২৫ ভাগ | শতকরা৭৫ ভাগ |
কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি | শতকরা ১৫ জন | শতকরা ৮৫ জন |
সামরিক বিভাগে চাকরি | শতকরা ১০ জন | শতকরা ৯০ জন |
চাউল (মণ প্রতি) | ৫০ টাকা | ২৫ টাকা |
আটা (মণ প্রতি) | ৩০ টাকা | ১৫ টাকা |
সরিষার তৈল (সের প্রতি) | ৫ টাকা | ২.৫০পয়সা |
স্বর্ণ প্রতি ভরি | ১৭০ টাকা | ১৩৫ টাকা |
ভাষা আন্দোলন
- মূল নিবন্ধ : বাংলা ভাষা আন্দোলন
সামরিক অসমতা
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙ্গালীরা অবহেলিত ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অংশে সমগ্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ ছিল বাঙ্গালী অফিসার এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রযুক্তিগত বা ব্যবস্থাপনার পদে ছিলেন। খুব অল্প সংখ্যক বাঙ্গালী অফিসার আদেশদানকারী পদ লাভের সুযোগ পেতেন। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করত বাঙ্গালীরা পশতুন বা পাঞ্জাবীদের মত "সাহসী" নয়। পাকিস্তানের বাজেটের একটি বিশাল অংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান এর সুফল সামান্যই পেত। ১৯৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঙ্গালীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয়।রাজনৈতিক অসমতা
জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতার বন্টন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূল হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান "এক ইউনিট তত্ত্ব" নামে এক অভিনব ধারণার সূত্রপাত করে, যেখানে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভোটের ভারসাম্য আনা। মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাঞ্জাব প্রদেশ প্রস্তাব করে পাকিস্তানে সরাসরি জনসংখ্যার বন্টনের ভিত্তিতে ভোট অনুষ্ঠিত হোক, কারণ পাঞ্জাবিরা ছিল সিন্ধি, পশতুন, বালুচ বা পাকিস্তানের অন্য যেকোন গোত্রের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। একেবারে শুরু থেকেই পাকিস্তানে শাসনের নামে ষড়যন্ত্র শুরু হয়, আর এই ষড়যন্ত্রে মূল ভূমিকা পালন করে সামরিক বাহিনী। যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোন নেতা, যেমন খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোন না কোন অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করত। নানারকম টালবাহানা করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েই চলে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমুখি হয় যখন ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু'জন প্রধানমন্ত্রী। "এক ইউনিট কাঠামো" নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো এমনকি মুজিবের ৬ দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে চার দফা দাবি পেশ করেন:- অবিলম্বে মার্শাল ল' প্রত্যাহার করতে হবে।
- সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।
- নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে।
- ২৫শে মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
১৯৭০ এর সাইক্লোনের প্রতিক্রিয়া
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভোলার সাইক্লোন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে, সেই সাথে জোয়ারের কারণে প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এটিকে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ হারিকেন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে। ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৪শে নভেম্বর এক সভায় মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা একটি দেশে গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।উত্তাল মার্চ
যদিও শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা কোন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। যদিও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বোনা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল এই সিদ্ধান্ত। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং শুধুমাত্র তাঁর মুখের কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে যায়। সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে কিন্তু বুলেটের ভয় দেখিয়ে বাঙ্গালিদের রাজপথ থেকে সরানো যায় না। ৫ দিন হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল তখন সামরিক বাহিনীতে চলতে থাকে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার পূর্বপ্রস্তুতি। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসাবে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়, কিন্তু কোন বাঙ্গালী বিচারপতি তাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি হন না। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার করতে থাকে, অপরদিকে চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণ। ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ভিত্তিতে "সরকারী যাত্রী" পরিবহণ করতে। এই "সরকারী যাত্রী"দের প্রায় সবাই ছিল শাদা পোষাকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সেনা। এমভি সোয়াত নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাকিস্তানী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙ্গালী প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলী চালাতে অস্বীকার করে, যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙ্গালী সৈনিকদের বিদ্রোহ।
অপারেশন সার্চলাইট
- মূল নিবন্ধ : অপারেশন সার্চলাইট
সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে "তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।" সে পরিকল্পনা মতোই ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।হত্যাকান্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান ক'রে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, বাঙালি হত্যা পুরো দেশজুড়ে চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল - জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ডের কথা অস্বীকার করেছে তবে হামিদুর রহমান কমিশনের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হল গুলোতে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিওটেপে ধারণ করেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইন্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনলজি (বর্তমান বুয়েট) এর প্রফেসর নূরুল উলা। পুরো বাংলাদেশেই হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো। ২রা আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, "হিন্দু,যারা মোট রিফিউজিদের তিন চতুর্থাংশ, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল"।
স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণাটি চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। ঘোষণাটি নিম্নরুপ:অনুবাদ: এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।[১১]২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েক'জন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নান প্রথম শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। পরে ২৭শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি শেখ মুজিবর রহমানে পক্ষে পুনরায় পাঠ করেন। ঘোষণাটি নিম্নরুপ:
অনুবাদ: মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।[১২][১৩]২৬শে মার্চ এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। আর ১৯৭১ সালে এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নয় মাস ব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
অস্থায়ী সরকার গঠন
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার -এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদ এর উপর।[১৪] বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।বিস্তারিতঃ ১৯৭১ সালের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার
যুদ্ধক্ষেত্র
- মূল নিবন্ধ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কালপঞ্জি
মার্চ থেকে জুন
ঢাকায় গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানী বাহিনী ১০ এপ্রিলের মধ্যে সারা বাংলাদেশ নিজেদের আয়ত্তে আনার পরিকল্পনা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এবং ছাত্র ও সাধারণ জনতা তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চট্টগ্রামে বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সদস্য ও ইপিআর এর সদস্যরা বিদ্রোহ করে শহরের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ পেতে পাকিস্তানী বাহিনীকে যুদ্ধজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করতে হয় এবং বিমান আক্রমণ চালাতে হয়।[১৫] কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলাতেও বাঙ্গালী সেনারা বিদ্রোহ করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা বিপুল সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্রশত্রের বলে মে মাসের শেষ নাগাদ এসব মুক্তাঞ্চল দখল করে নেয়।মার্চের শেষদিক হতেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থক এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের বিশেষভাবে তাদের রোষের শিকার হয়। দলে দলে মানুষ ভারত সীমান্তের দিকে পালাতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শরণার্থীদের এই স্রোত নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এ সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন ও অপ্রস্তুত। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে শুরু করে। ১১ জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। কর্ণেল এম এ জি ওসমানীকে কমান্ডার ইন চিফ, লেফট্যানান্ট কর্ণেল আবদুর রবকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে ডেপুটি চিফ অফ আর্মি স্টাফ ও চিফ অফ এয়ার ফোর্সের দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা অফিসারদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে কমান্ডার নির্বাচন করা হয়। ১০ নং সেক্টরটি ছিল কমান্ডার ইন চিফের (সি-ইন-সি) সরাসরি তত্ত্বাবধানে, যার মধ্যে নৌ-বাহিনী ও সি-ইন-সির বিশেষ বাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১৬] তবে উপযুক্ত কোন অফিসার ছিল না বলে ১১ নং সেক্টরের (নৌ সেক্টর) কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না; এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যখন যে সেক্টরে অপারেশন চালাতেন, তখন সে সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের অধীনে থাকতেন।[১৭] মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগ ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সীমান্ত এলাকায় এবং ভারতের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ লাভ করত। সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তিনটি ব্রিগেড (১১ ব্যাটালিয়ন) তৈরি করা হয়। এছাড়াও প্রায় ১,০০,০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের ভেতরে নিয়মিত বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো হত।যুদ্ধক্ষেত্র | বিস্তৃতি | কমান্ডার |
---|---|---|
১নং সেক্টর | চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত | মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল - জুন), মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (জুন-ডিসেম্বর) |
২নং সেক্টর | নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর ও ঢাকার অংশবিশেষ | মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর), মেজর এ.টি.এম. হায়দার(সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) |
৩নং সেক্টর | সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ | মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর), মেজর এ.এন.এম. নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) |
৪নং সেক্টর | সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি সড়ক পর্যন্ত | মেজর সি.আর. দত্ত |
৫নং সেক্টর | সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সিলেট জেলার সমগ্র উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল | মীর শওকত আলী |
৬নং সেক্টর | সমগ্র রংপুর জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা | উইং কমান্ডার এম.কে. বাশার |
৭নং সেক্টর | দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা জেলা | মেজর কাজী নুরুজ্জামান |
৮নং সেক্টর | সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ | মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (এপ্রিল- আগস্ট), মেজর এম.এ. মনজুর (আগস্ট-ডিসেম্বর) |
৯নং সেক্টর | দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনার দক্ষিণাঞ্চল এবং সমগ্র বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা | মেজর এম.এ. জলিল (এপ্রিল-ডিসেম্বর প্রথমার্ধ), মেজর জয়নুল আবেদীন ( ডিসেম্বর এর অবশিষ্ট দিন) |
১০নং সেক্টর | কোনো আঞ্চলিক সীমানা নেই। নৌবাহিনীর কমান্ডো দ্বারা গঠিত। শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হত | -- |
১১নং সেক্টর | কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল | মেজর আবু তাহের (আগস্ট-নভেম্বর),ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) |
টাংগাইল সেক্টর | সমগ্র টাংগাইল জেলা ছাড়াও ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার অংশ | কাদের সিদ্দিকী |
আকাশপথ | বাংলাদেশের সমগ্র আকাশসীমা | গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার |
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর
মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী বর্ডার পোস্টগুলো একে একে দখল করে নিতে শুরু করে। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী কমলপুর, বিলোনিয়া, বয়রা প্রভৃতি বর্ডার পোস্টে হামলা করে এবং ৩০৭টি পোস্টের ৯০টিই দখল করে নেয়। পাশাপাশি গেরিলা বাহিনীর হামলাও তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর নিয়মিত কাজ ছিল সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করা এবং দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীদের নির্যাতন করা। সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের জবাবে তারা এ অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তারা দিনের বেলাতেও নিজেদের সামরিক ঘাঁটি থেকে বের হতে ভয় পেত। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জরুরী ভিত্তিতে ৫ ব্যাটালিয়ন সৈন্য তলব করা হয়।ধীরে ধীরে পাকিস্তানী দখলদারী বাহিনীর অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।’ পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারত ভূখণ্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে।[১৮] ৩রা ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” [১৯]ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে; (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে; (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু’ ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।[২০] যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানী ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী উর্ধ্বতন অফিসাররা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিল উত্তরে চীন ও দক্ষিণে আমেরিকা থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে না।
জাতিসংঘে কূটনৈতিক তৎপরতা
৪ঠা ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের আহূত অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী সম্বলিত মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি নেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে উপমহাদেশের সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করেন। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হবার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা,ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমান্তের ভিতরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সোভিয়েট প্রতিনিধি এই প্রস্তাবকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করেন। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোট দানে বিরত থাকে।[২১] পরদিন ৫ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েট ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাক-বাহিনীর যে সহিংসতার দরুন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তাও অবলিম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে।অন্য সকল সদস্য ভোটদানে বিরত থাকে। ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়োগ করে। একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েট সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানান, এই সংঘর্ষ সোভিয়েট সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় ‘এর সঙ্গে সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান।[২২]আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
৬ই ডিসেম্বরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। “বেলা এগারোটার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষণা করা হলো যে ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে বলা যায়, গোটা বিশ্ব এখন সচেতন যে তারা জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী অনেক সরকারই যেমনটা দাবি করতে পারবে না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের বহু খ্যাত উক্তি অনুসারে বাংলাদেশের সরকার সমর্থিত হচ্ছে ‘পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত জাতির আকাঙ্ক্ষা বা উইল অব দ্য নেশন’ দ্বারা। এই বিচারে পাকিস্তানের সামরিক সরকার, যাদের তোষণ করতে অনেক দেশই বিশেষ উদগ্রীব, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও প্রতিনিধিত্ব করে না।”[২৩]৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুগ্মভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন।বাংলাদেশ সরকারের ৪ ডিসেম্বরের পত্রের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে যে পত্র প্রেরণ করেন তার আংশিক বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ :
"সত্যের জয় হোক প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লি ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আপনি ৪ঠা ডিসেম্বর আমাকে যে বাণী প্রেরণ করেছেন তাতে আমি ও ভারত সরকারে আমার সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। এই পত্র পাবার পর আপনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি সানন্দে জানাই যে, বর্তমানে বিরাজিত পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি একটি অনুলিপি সংযুক্ত করছি। আপনার বিশ্বস্ত ইন্দিরা গান্ধী।" [২৪]
আত্মসমর্পণ ও পরবর্তী ইতিহাস
৯ ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন।[২৫] এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্রসংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এই আবেদনে আরো লেখা ছিল ,‘যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।’[২৬]
এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়।পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।[২৭]
মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পন করার জন্যে আহবান করে। গভর্ণর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমা ফেলার কারণে গভর্ণর মালেকের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের পদলেহী সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল (বর্তমান হোটেল শেরাটন) আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত লিফলেট ফেলা হতে থাকে।
অবশেষে নিয়াজীর অনুরোধে ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। পরদিন সকালে বিমানাক্রমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলীর মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছ’ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ জানান যাতে অস্ত্র সমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়। এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে অবশ্য মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকী বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন এবং সেখান থেকে নাগরা নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার পর সকাল ১০:৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যেকব মধ্যাহ্নে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকা প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকা অবতরণ করেন।কিছু পরেই ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। [২৮]
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেট. জেন. এ. এ. কে নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে।প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্খিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়ে যায়।পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
[সম্পাদনা] গণহত্যা
- মূল নিবন্ধ : ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন রকম পরিসংখ্যান প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন এনাসাইক্লোপেডিয়া ও বইতে এই সংখ্যাটিকে ২,০০,০০০ থেকে শুরু করে ৩০,০০,০০০ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।[৭]বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাটিকে ৩০,০০,০০০ হিসেবে অনুমান করা হয়। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, যারা সে সময় দেশত্যাগ না করলে হয়তো গণহত্যার শিকার হত।[২৯]
স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী[৩০]পাকিস্তান আর্মির নির্দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে - যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী - ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে।[৩১] পাকিস্তানের পদলেহী বাংলাদেশী বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের দল ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়, যার মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি অন্যতম (বর্তমানে এ বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে)। ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং মাঝে মাঝেই এমন নতুন বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হচ্ছে (উদাহরণস্বরূপ ঢাকায় অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে একটি কূপের ভেতর গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়)।[৩২] ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান কনসুলেটের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেটস ডিপার্টমেন্টে পাঠানো টেলিগ্রামেও যুদ্ধশুরুর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনতার ওপর চালানো নৃশংস হত্যাকান্ডের উল্লেখ রয়েছে।[৩৩]
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বহুসংখ্যক বাঙ্গালি নারী সম্ভ্রম হারায়; যার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ধারণা করা হয় প্রায় ২,০০,০০০ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম নেয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পাকিস্তান আর্মি বহু সংখ্যক মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে।[৩৪]
বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া
১৯৭১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের প্রধানতম মিত্র এবং যুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও বস্তুগত- উভয়ভাবেই সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের কিছুই করার নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় আঁচ করতে পেরে নিক্সন ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়ন করেন, যা ভারতীয়রা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরু করার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে। এন্টারপ্রাইজ ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর গন্তব্যে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকির জবাব হিসেবে সোভিয়েত নৌবাহিনী ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী দু'টি ডুবোজাহাজ ভ্লাডিভস্টক থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে; যারা ইউএস টাস্ক ফোর্স ৭৪ কে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে তাড়া করে বেড়ায়।নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সোভিয়েত বিস্তার আশঙ্কা করছিলেন। পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, যাদের সাথে নিক্সন সম্পর্কোন্নয়নের কথা ভাবছিলেন এবং ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারিতে তার চীন সফরের পরিকল্পনা ছিল। নিক্সন আশঙ্কা করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের আগ্রাসনের ফলে ওই অঞ্চলে সোভিয়েত রাজত্ব কায়েম হবে, যা কিনা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সম্ভাব্য নতুন মিত্র চীনের আঞ্চলিক অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি সাধন করবে। চীনের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্যে নিক্সন পাকিস্তানের জন্যে ইউএস কংগ্রেসের বরাদ্দকৃত বাজেট লঙ্ঘন করে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রেরণ করেন,[৩৫] পাশাপাশি চীনকেও পাকিস্তানে অস্ত্র-শস্ত্রের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে উৎসাহিত করেন।
নিক্সন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার খবর সম্বন্ধে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে বহুল আলোচিত ব্লাড টেলিগ্রাম অন্যতম।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন প্রদান করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করে। সোভিয়েতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে তার প্রতিপক্ষ আমেরিকা ও চীনকে হীনবল করবে। সোভিয়েত রাশিয়া ভারতকে আশ্বাস দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন যুদ্ধে সম্পৃক্ত হলে তারা এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই আলোকেই ১৯৭১ এর আগস্টে ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি সম্পাদিত হয়। আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত রাশিয়া এর জবাবে দু'টি সাবমেরিন পাঠায়।
তথ্যসূত্র
- ↑ ১.০ ১.১ India - Pakistan War, 1971; Introduction - Tom Cooper, Khan Syed Shaiz Ali
- ↑ Pakistan & the Karakoram Highway By Owen Bennett-Jones, Lindsay Brown, John Mock, Sarina Singh, Pg 30
- ↑ p442 Indian Army after Independence by KC Pravel: Lancer 1987 [ISBN 81-7062-014-7]
- ↑ ৪.০ ৪.১ Figures from The Fall of Dacca by জগজিত সিং অরোরা in The Illustrated Weekly of India dated 23 December 1973 quoted in Indian Army after Independence by KC Pravel: Lancer 1987 [ISBN 81-7062-014-7]
- ↑ Figure from Pakistani Prisioners of War in India by Col S.P. Salunke p.10 quoted in Indian Army after Independence by KC Pravel: Lancer 1987 [ISBN 81-7062-014-7]
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি: অবৈধ
ট্যাগ;
deathcount-pakistani
নামের refগুলির জন্য কোন টেক্সট প্রদান করা হয়নি - ↑ ৭.০ ৭.১ Matthew White's Death Tolls for the Major Wars and Atrocities of the Twentieth Century
- ↑ Genocide in Bangladesh, 1971. Gendercide Watch.
- ↑ পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত চতুর্থ মেয়াদী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য উপদেষ্টা প্যানেলের রিপোর্ট।
- ↑ Debasish Roy Chowdhury. “'Indians are bastards anyway'”, Asia Times, 2005-06-23।
- ↑ বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত
- ↑ বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত
- ↑ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার অডিও (সাক্ষাৎকার - বেলাল মোহাম্মদ)
- ↑ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (পৃষ্ঠা ১০-১১) - মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- ↑ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (পৃষ্ঠা ৯) - মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- ↑ Bangladesh Liberation Armed Force, Liberation War Museum, Bangladesh.
- ↑ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (পৃষ্ঠা ১০) - মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- ↑ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2009-12-03/news/22848
- ↑ http://www.profile-bengal.com/muldhara/Muldhara_71_chapter_21.htm
- ↑ http://www.profile-bengal.com/muldhara/Muldhara_71_chapter_21.htm
- ↑ মূলধারা ৭১ গ্রন্থ অধ্যায় ২১
- ↑ মূলধারা ৭১ গ্রন্থ অধ্যায় ২১
- ↑ http://www.prothom-alo.com/detail/news/23563 দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত ধারাবাহিক নিবন্ধ
- ↑ http://www.sangbad.com.bd/?view=details&pub_no=198&menu_id=23&news_type_id=1&type=single&val=18713 দৈনিক সংবাদ
- ↑ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2009-12-10/news/24409
- ↑ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2009-12-10/news/24409
- ↑ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2009-12-10/news/24409
- ↑ http://www.profile-bengal.com/muldhara/Muldhara_71_chapter_21.htm
- ↑ Rummel, Rudolph J., "Statistics of Democide: Genocide and Mass Murder Since 1900", ISBN 3-8258-4010-7, Chapter 8, Table 8.2 Pakistan Genocide in Bangladesh Estimates, Sources, and Calcualtions: lowest estimate two million claimed by Pakistan (reported by Aziz, Qutubuddin. Blood and tears Karachi: United Press of Pakistan, 1974. pp. 74,226), all the other sources used by Rummel suggest a figure of between 8 and 10 million with one (Johnson, B. L. C. Bangladesh. New York: Barnes & Noble, 1975. pp. 73,75) that "could have been" 12 million.
- ↑ Many of the eyewitness accounts of relations that were picked up by "Al Badr" forces describe them as Bengali men. The only survivor of the Rayerbazar killings describes the captors and killers of Bengali professionals as fellow Bengalis. See 37 Dilawar Hossain, account reproduced in ‘Ekattorer Ghatok-dalalera ke Kothay’ (Muktijuddha Chetona Bikash Kendro, Dhaka, 1989)
- ↑ “125 Slain in Dacca Area, Believed Elite of Bengal”, New York Times, 19 December 1971, p. 1। 2008-01-04 তারিখে সংগৃহীত। “At least 125 persons, believed to be physicians, professors, writers and teachers were found murdered today in a field outside Dacca. All the victims' hands were tied behind their backs and they had been bayoneted, garroted or shot. They were among an estimated 300 Bengali intellectuals who had been seized by West Pakistani soldiers and locally recruited supporters.”
- ↑ DPA report Mass grave found in Bangladesh in The Chandigarh Tribune 8 August 1999
- ↑ Sajit Gandhi The Tilt: The U.S. and the South Asian Crisis of 1971 National Security Archive Electronic Briefing Book No. 79 16 December 2002
- ↑ East Pakistan: Even the Skies Weep, Time Magazine, 25 October 1971.
- ↑ Shalom, Stephen R., The Men Behind Yahya in the Indo-Pak War of 1971
প্রসংঙ্গিক নিবন্ধসমূহ
আরও দেখুন
|
|
বহিঃসংযোগ
- মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাপিডিয়ার নিবন্ধ
- মুক্তিযুদ্ধের ওপর ৫টি তথ্যচিত্রের অংশ
- Video, audio footage, news reports, pictures and resources from Mukto-mona
- Picture Gallery of the Language Movement 1952 & the Independence War 1971 of Bangladesh
- Bangladesh Liberation War. Mujibnagar. Government Documents 1971
- Images of genocide committed by Pakistan Army in Bangladesh Graphic images, viewer discretion advised
- Video, audio footage, news reports, pictures and resources from Muktomona
- Virtual Bangladesh: History: Holocaust 1971
- Case Study: Genocide in Bangladesh, 1971 from Gendercide.org
- Torture in Bangladesh 1971–2004 (PDF)
- Eyewitness Accounts: Genocide in Bangladesh
- Genocide 1971
- The women of 1971. Tales of abuse and rape by the Pakistan Army.
- Eyewitness account of the massacre at Dhaka University
- Mathematics of a Massacre, Abul Kashem
- The complete Hamoodur Rahman Commission Report
- 1971 Massacre in Bangladesh and the Fallacy in the Hamoodur Rahman Commission Report, Dr. M.A. Hasan
- Women of Pakistan Apologize for War Crimes, 1996
- Pakistan Army not involved in 1971 Rapes, by Khalid Hasan, Daily Times, 30 June 2005.
- Against Our Will: Men, Women and Rape by Susan Brownmiller, 1975
- Sheikh Mujib wanted a confederation: US papers, by Anwar Iqbal, Dawn, 7 July 2005
- Page containing copies of the surrender documents
- A website dedicated to Liberation war of Bangladesh
- Video clip of the surrender by Pakistan
- Bangladesh Liberation War Picture Gallery Graphic images, viewer discretion advised
0 comments:
Post a Comment